Thursday, June 5, 2014

ষষ্ঠীপুজো

ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে কোনও জামাই-টামাই দেখিনি। নিজের কোনও পিসি ছিল না তো, পিসেমশাই আসবে কোত্থেকে? জ্যেঠতুতো দিদি আমার থেকে দশ বছরের বড়, তখনও কিশোরী, তার বিয়ে হয়নি। আর আমার বোনেরা তখন জন্মায়নি। কিন্তু ষষ্ঠীপুজোর চল ছিল বাড়িতে। ঠাকুরমার উদ্যোগে মা ষষ্ঠীর ব্রত করতেন। আমার মায়ের বাপের বাড়ি ছিল বরিশাল, তাঁদের পরিবারে ষষ্ঠীপুজোর আস্য ছিল না। এ নিয়ে বাবাকে দু-একবার কৌতুকভরে আক্ষেপ করতেও শুনেছি। আমরা ছিলাম যশুরে। তবে ঠাকুরমা তাঁর বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে শাশুড়ি বা বড়-জা কাউকে পাননি বলে নিজের বাপের বাড়ির ঢাকাই নিয়মকানুন চালু করে দিয়েছিলেন। যা বলছিলাম, ছেলেবেলায় বাড়িতে বেশ ধুমধাম করে ষষ্ঠীপুজো হতে দেখেছি। পুরোহিতমশাই আসতেন, মন্ত্র-টন্ত্র পড়তেন। তিনি পুজো সাঙ্গ করে চলে যাবার পর একটা ব্রতকথা বলতেন মা, ঠাকুরমা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ঠাকুরমা ছাড়া আর কেউ সেটা শুনত কিনা সন্দেহ, দিদি বোধহয় শুনত, আর আমাদের মন পড়ে থাকত আম-কাঁঠাল-লিচু-জামরুল আর দই-রসগোল্লার দিকে। তবে যতটুকু কানে আসত, তাতেই বুঝতাম ষষ্ঠী ছিলেন মঙ্গলকাব্যের দেবীদের মতো বেশ প্রতিশোধপরায়ণা, তাঁর মাহাত্ম্যের অনেকটাই নিহিত ছিল তাঁর ক্ষতি করার ক্ষমতার ভিতরে। মঙ্গলকাব্য বললাম নেহাত তুলনার খাতিরে, নইলে ওসবের কোনও ধারণাই ছিল না তখন।

লোকদেবী হলেও পুরাণে ষষ্ঠীর উল্লেখ আছে বলে শুনেছি, হিতৈষিণীরূপে তাঁর বিবর্তনের ইতিহাসও হয়তো অলভ্য নয়। তাঁর কার্যকলাপ ছিল মূলত দ্বিবিধ। জাত সন্তানদের রক্ষা করতেন তিনি, মঙ্গলবিধান করতেন। আর অজাত সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখার পথ সুগম করতেন। সোজা কথায় তিনি ছিলেন উর্বরতার –  অবশ্যই নারীর উর্বরতার – লোকদেবী;  পুরুষদের নিয়ে প্রাচীন লোকসমাজের তেমন চিন্তা ছিল বলে মনে হয় না, যদিও মহাভারতেই ক্ষেত্রজ পুত্রের প্রসঙ্গ আছে। তাই এই উর্বরতাস্তুতির সঙ্গে জামাতা বাবাজীবন যুক্ত হলেন কী করে তার সমাজতাত্ত্বিক কারণ আমার জানা নেই। বন্ধুরা কেউ কেউ বলতে পারবেন হয়তো। আমার যেটা মনে হয়, এই জামাই-তোষণ অনেকটাই শ্বশুর-শাশুড়ির মনের আশঙ্কাসঞ্জাত।  ‘আমার মেয়েটাকে বিশ্বাস করে তোমার হাতে দিয়েছি বাবা, ওকে ভালো রেখো, কষ্ট দিয়ো না, অত্যাচার কোরো না। তোমার মায়ের গঞ্জনার পরিমাণ মাত্রা ছাড়ালে একটু বাধা-টাধা দিয়ো।’  এই অনুচ্চারিত মিনতিটিই যেন নিহিত থাকত শাশুড়ির সহৃদয় আতিথেয়তায় : ‘আর এক টুকরো ইলিশমাছ নেবে, বাবা? পাঁঠার মাংস দেব আর একটু? দই-রসগোল্লা যা দিয়েছি সব খেতে হবে কিন্তু।’ এখন পরিস্থিতি পালটেছে, বিশেষত শহরাঞ্চলে, ঐতিহ্যটা রয়ে গেছে।

ভেজানো চাল মিহি করে বেটে আমাদের বাড়িতে ষষ্ঠীঠাকুর গড়া হত। এ কাজটা করত দিদি। আমিও হাত লাগাতাম। দিদি বলত, ‘তুই ছয় ছেলে গড়, ওটা সোজা।’  আমি বলতাম, ‘না, আমি বেড়াল গড়ব।’  কাঁঠাল বহুপ্রজ বৃক্ষ, ষষ্ঠীর সিম্বলিজমের সঙ্গে মানানসই, তাই তার একটা পল্লব ভেঙে একতাল কাদামাটির মধ্যে ডালের দিকটা গুঁজে দিয়ে কাঁঠালগাছ বানানো হত, সেই গাছের তলায় পা ছড়িয়ে বসতেন শাদারঙের ষষ্ঠীঠাকরুন।  সওদাগরবউয়ের হলুদরঙা ছয় সন্তান বিরাজ করত তাঁর দু-পাশে, আর পায়ের কাছে থাকত তাঁর বাহন কালোরঙের বেড়ালটি। চালবাটার সঙ্গে হলুদগুঁড়ো ও দোয়াতের কালি মিশিয়ে যথাক্রমে ছয় ছেলের হলুদরঙ ও বেড়ালের কালোরঙ করা হত।

জ্যেঠতুতো দিদির বিয়ে হল ষাটের দশকের শেষের দিকে। কাছেই, আলিপুরদুয়ার জংশনে। জামাইবাবু রেলে চাকরি করতেন। প্রত্যেক বছর ষষ্ঠীর দিন আসতেন আমাদের কোচবিহারের বাড়িতে। পুজো এবং খাওয়াদাওয়া মিলিয়ে বাড়িতে সে এক এলাহি ব্যাপার সেদিন। ষষ্ঠীর দিন সকালবেলায় তালপাতার পাখায় বটপাতা-অশথপাতা খেজুর-করমচা এবং একটা গোটা ফল নিয়ে স্নান করতেন মা, সন্তানের শুভকামনায় ওটাই ছিল মায়েদের প্রধান মাঙ্গলিক কাজ, তারপর ওই পাখার বাতাস দিতেন আমাদের গায়ে। ক্রমে আমাদের ভাইদেরও বিয়ে হল একে একে, আমরা ছড়িয়ে পড়লাম এদিক-সেদিক। তবে সুযোগ হলে ষষ্ঠীর দিন বাড়িতে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতাম। বছরে ওই একবারই মাত্র পাড়ার সুবিশাল ডাঙ্গর-আই দিঘিতে স্নান করতে যেতেন মা, সঙ্গে পুত্রবধূরা। এই ছবিটি মনে হয় ১৯৯৫ বা ১৯৯৬ সালের। এখন মা অ্যালঝাইমারগ্রস্ত। ভ্রাতৃবধূদের সৌজন্যে কোচবিহারের বাড়ির ট্র্যাডিশনটি স্তিমিতভাবে এখনও বজায় আছে। ....................................................... প্রদীপ রায়, Facebook-এ, ইং ৪ঠা জুন ২০১৪-তে প্রথম প্রকাশিত

No comments:

Post a Comment